হবিগঞ্জ প্রতিনিধি:-
হবিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর তীররক্ষা প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই বাঁধের বিভিন্ন ব্লকে ফাটল দেখা গিয়েছে। একইসঙ্গে বাঁধের বিভিন্ন স্থান দেবে গেছে। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় কাজ শেষ হওয়ার আগেই ৫৭৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী।
স্থানীয় সূত্র জানায়, হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের কাজ চলছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। কোনও কোনও জায়গায় ব্লক দেবে গেছে।
পাউবো বলছে, কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেইসঙ্গে কিছু ব্লক দেবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থান পুনরায় সংস্কার করা হবে।এলাকাবাসীর অভিযোগ, কাজ শুরুর পর থেকে কুশিয়ারার তীর প্রতিরক্ষায় ব্লক নির্মাণে মাটিযুক্ত বালু, নুড়ি পাথর, ছোট পাথরের জায়গায় বড় পাথর, গোটা পাথর, মরা পাথর ও পাথরের সঙ্গে ধুলাবালুযুক্ত অবস্থায় ঢালাই, ইটের খোয়া মিশ্রণ, অধিকাংশ স্থানে সিমেন্টের তুলনায় অতিরিক্ত বালু ব্যবহারসহ নানা অনিয়ম হয়েছে। তদারকির দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের জোগসাজশে এমন অনিয়ম হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতি বছর বর্ষাকালে হবিগঞ্জের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ‘কুশিয়ারা ডাইক’ ভেঙে যায়। এতে জেলার নবীগঞ্জ, সিলেটের ওসমানীনগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামসহ ভাটি এবং হাওর অঞ্চলের বাড়িঘর এবং কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে যায়। এ অবস্থায় নদী তীরের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুশিয়ারার উভয় তীর রক্ষায় প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে কাজ পায় পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো গোলাম রব্বানী কনস্ট্রাকশন, এএইচ ট্রেডিং করপোরেশন, আরএফএল, নেশন টেক কমিউনিকেশনস ও আবুল কালাম করপোরেশন। ১১টি প্যাকেজে কাজ শুরু করে তারা। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও শেষ হয়নি। কাজ শেষ হতে আগামী জুন-জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
তবে এর মধ্যে এএইচ ট্রেডিং, আরএফএল ও নেশন টেকের কাজে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে আরএফএল-এর প্রকল্প পরিচালক রাসেল আহমদ বলেন, ‘শুধু আমাদের নয়, সবার কাজেই ফাটল দেখা দিয়ে নিচের অংশ দেবে গেছে। পুনরায় কাজ সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে জানতে অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করলেও ফোন রিসিভ করেননি তারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নবীগঞ্জের পাহাড়পুর অংশে এএইচ ট্রেডিংয়ের শ্রমিকরা ব্লক নির্মাণ করছেন। সেখানে গুণগত মানের সিমেন্ট ব্যবহার করা হলেও মরা পাথর ও অতিরিক্ত বালু ব্যবহার করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তা আরাফাত খান কোনও কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশন টেক ও আরএফএল নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ব্লক নির্মাণের ফলে লামা তাজপুর এলাকার খোয়াজ উল্লাহ, জিলু মিয়া ও বাছিত মিয়ার বাড়ির সামনেসহ বেশ কিছু স্থানে ব্লক দেবে গেছে।
নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করায় প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ব্লক দেবে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শেরপুর এলাকার বাসিন্দা জুয়েল আহমদ।
শুরু থেকে নিম্নমানের বালু ও মরা পাথর দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্লক নির্মাণ করে আসছে জানিয়ে তাজপুর এলাকার বাসিন্দা তফুর আলী বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আসেন, সবকিছুই দেখেন। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেন না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তারা মিলেমিশে দুর্নীতি করে আসছেন। তাই মামলার ভয়ে প্রতিবাদ করেন না এলাকার মানুষজন।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে লামা তাজপুরের খোয়াজ উল্লাহ বলেন, ‘কে করবে প্রতিবাদ, কোথায় করবে, কার কাছে করবে? এত কোটি টাকার প্রকল্প, আমরা প্রতিবাদ করলে অল্পকিছু টাকা খরচ করলেই আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা যাবে। কর্মকর্তারা সবকিছু জেনেও চুপ আছেন।’
নিম্নমানের পাথর দিয়ে ব্লক তৈরি করা হচ্ছে অভিযোগ করে একই এলাকার জিলু মিয়া বলেন, ‘কাজে বালু-পাথর ও সিমেন্ট মিশ্রণের সঠিক অনুপাত মানা হচ্ছে না। এজন্য ফাটল দেখা দিয়েছে।একই অভিযোগ করেছেন নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম। তিনি বলেন, ‘ব্লক নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে দ্রুত কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই। না হয় কাঠ ঠিকমতো হবে না।’
অনেক কষ্ট করে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় প্রকল্প নিয়ে এলাম। কিন্তু ব্লক নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে জানিয়েছেন হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ।
কিছু স্থানে ব্লক নির্মাণে নিম্নমানের পাথর ও বালু ব্যবহারের অভিযোগ পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘কিছু স্থানে নরম মাটি থাকার কারণে ব্লক দেবে গেছে। এরপর আমরা সরেজমিনে ওসব স্থান পরিদর্শন করেছি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেবে যাওয়া ব্লক পুনরায় বালু ও জিও টিউব দিয়ে বসানোর নির্দেশনা দিয়েছি।’
Leave a Reply