অনলাইন ডেস্ক:-
মারুফা আক্তারকে অল্প বয়সেই বসতে হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় তার পড়াশোনা। সবার মতো তারও শুরু হয় সংসার জীবনের ব্যস্ততা। তবে বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছা মনোবল থাকলে যে অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব তা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। স্বজন ও প্রতিবেশীদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ উপেক্ষা করে এবার মেয়ের সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৩৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন চার সন্তানের জননী মারুফা। তবে মেয়ে ফেল করায় আনন্দে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, মারুফা আক্তার ডিমলার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহাবিদ্যালয়ের কারিগরি শাখা থেকে মেয়ের সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৩৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার মেয়ে শাহী সিদ্দিকা একই কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছেন।
এর দুই বছর আগে এসএসসি পরীক্ষায় একসঙ্গে অংশ নিয়ে মেয়ের চেয়ে ভালো ফলাফল করেন মারুফা। তিনি এসএসসিতে জিপিএ-৪.৬০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন এবং তার মেয়ে শাহী সিদ্দিকা পেয়েছিল জিপিএ-৩.০০। ২০০৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু পরীক্ষার আগেই অভিভাবকেরা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। সংসারে দারিদ্র্যতার কারণে একইভাবে মেয়ে শাহী সিদ্দিকাকেও দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন মারুফা।
অদম্য এই নারী নীলফামারীর ডিমলার খালিশা চাপানি ইউনিয়নের পুন্যারঝার গ্রামে সাইদুল ইসলামের স্ত্রী। মারুফার স্বামী পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মেয়ে শাহী সিদ্দিকা বড়। দ্বিতীয় ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী, তৃতীয় মেয়ে নবম শ্রেণি ও ছোট মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করা অবস্থায় অদম্য ইচ্ছেটা বুকের মধ্যে রেখে মারুফা আক্তারকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। বিয়ের পর বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। পিঠাপিঠি চার ছেলে-মেয়েকে মানুষ করতেই চলে যায় ১৫ বছর। সচরাচর কোনো কারও লেখাপড়ার ইচ্ছাশক্তি আর এতো বছর বাঁচে না। কিন্তু মারুফা আক্তার দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে জয় করা যায়। দীর্ঘ ১৫ বছরে অভাবের সংসারে চারজন নতুন অতিথি এলেও মারুফার লেখাপড়ার ইচ্ছা দমেনি।
এত কিছুর পরও মারুফা চেষ্টা অব্যাহত রাখেন, কীভাবে নিজেকে এবং মেয়েকে লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনা যায়। এরই চেষ্টায় স্থানীয়ভাবে নিজেকে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। কিছুটা হলেও সংসারে আয় ফিরতে শুরু করে। নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে সুপ্ত বাসনাকে পূরণ করতে স্বামীর উৎসাহে মেয়ের সঙ্গে পুনরায় ছোটখাতা ফাজিল মাদরাসায় ভর্তি হন নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২০ সালে মেয়ের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন মারুফা। এমনকি মেয়ের চেয়ে ভালো ফলাফল করেন তিনি। সারাদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর গভীর রাত ও ভোরে উঠে নামাজ শেষে লেখাপড়া শুরু করেন।
মারুফা আক্তার তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ডিমলা বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট কেন্দ্র থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। তার ইচ্ছা সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তিনিও নিজেকে একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে পরিচয় দেবেন। মারুফার আশা পূরণ হয়েছে, তবে মেয়ের ফল খারাপের কারণে কিছুটা হলেও মন খারাপ। এদিকে মারুফার এ ফলাফলে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই খুশি।
মারুফা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোট থেকে পড়াশোনার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল। অভাবের সংসারে বড় হয়েছি। ২০০৩ সালে যখন এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পরীক্ষার আগেই বিয়ে দিয়ে দেন বাবা-মা। ইচ্ছা থাকলেও প্রতিবাদ করে পড়াশোনাটা করতে পারিনি। তবে পড়াশোনার তাড়না মনে দাগ কেটেছে সব সময়।
তিনি বলেন, বিয়ের পর চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের পড়ার কথা ভাবার সময়ই হয়নি। পরে নিজের অদম্য ইচ্ছা ও স্বামী-সন্তানদের অনুপ্রেরণায় আবার পড়াশোনা শুরু করি। সমাজের আর দশটা মানুষের মতো আমিও একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে যাতে পরিচয় দিতে পারি এজন্যই কষ্ট করে পড়াশোনাটা আবার শুরু করেছি। এইচএসসি পাস করে কষ্ট সার্থক হয়েছে।
মারুফা বলেন, মেয়ের ফলাফল খারাপ হওয়ায় সবার মন খারাপ হলেও আমার ফলাফলে সবাই খুশি। এবার উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
মারুফা আক্তারের স্বামী সাইদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তার ইচ্ছেটার মর্যাদা দিয়েছি। সে যতদূর পড়াশোনা করতে পারে, আমি চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করব। তার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। মা ও মেয়ে একসঙ্গে পাস করলে আরও ভালো লাগতো।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চরম দারিদ্র্যের মাঝেও প্রত্যন্ত গ্রামের মারুফা এইচএসসিতে শুধু পাসই করেনি, ভালো ফলাফল অর্জন করেছেন। তার বিষয়টি আসলে অবাক লাগার মতো। বিষয়টি অনেকের অনুপ্রেরণা দেবে। উচ্চতর শিক্ষায় লেখাপড়ার সুযোগ পেলে আমরাও তার পরিবারকে সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দেব। আমি চাই তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করুক।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মারুফা একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকলে লেখাপড়ায় বয়স কোনো বাধা নয় তিনি সেটা প্রমাণ করেছেন। মারুফা আক্তারের এমন উদ্যোগ অনেককে অনুপ্রাণিত করবে। আমরা তার সাফল্য কামনা করি।