নুর সাইদ ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার:-
প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ও বরেন্দ্র জনপদের এক সময়ের প্রাণকেন্দ্র যোগীর ঘোপা। এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার দক্ষিণ- পূর্ব সীমান্তবর্তী এবং পত্নীতলা উপজেলার পূর্ব- উত্তর প্রান্তে আমাইড় ইউনিয়নের চকভবানী মৌজায় অবস্থিত।
যোগীর ঘোপা নাথ পন্থীদের আশ্রম ধর্ম প্রচার কেন্দ্র ও আবাসস্থল অবস্থিত এর ইতিহাস উন্মোচনে লেখক ও প্রভাষক মোঃআব্দুর রাজজাক (রাজু) এ তথ্য মতে জানা যায়,প্রাচীন বাংলার উর্বর ভূমিতে জন্ম নেওয়া উদার মানষিকতার মানুষের মাঝে হাজার বছর ধরে লালিত্যময় বহুবিধ ধর্মমতের চর্চা। এই অঞ্চলে প্রচারিত ধর্মমত গুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ধর্মমত ছিলো নাথধর্ম। যোগীর ঘোপা বা যোগীর ভবন কি? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,যোগীঘোপা নামকরণে মধ্যেই গ্রামটির প্রাচীনত্ব নিহত শব্দটির আদি রূপ গোফা। যোগী শব্দের অর্থ হিন্দু তপস্বী বা সন্ন্যাসী নাথ ধর্মালম্বী হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ।কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে তাঁরা ছিলো সহ জিয়া বৌদ্ধ ধর্মালম্বী সম্প্রদায়। আর গুফা বা গোফা শব্দের অর্থ হলো গুহা।অর্থাৎ জুগিরগোফা বলতে গুহা বা নিভৃতে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত একদল নাথ ধর্মাবলম্বী তপস্বীদের বুঝায়।
নাথ ধর্ম কি? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,নাথ ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত ধর্ম প্রচারকদের একটি ভিন্ন শাখা। ম্যসেন্দ্র নাথ ছিলেন এই ধর্মের প্রবর্তক। আদিতে তিনি ছিলেন একজন বৌদ্ধ গুরু। তার প্রধান শিক্ষা গুরু গোরক্ষ নাথের সময় সমগ্র বাংলায় এই ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলার বাইরে ও এর বিস্তার ঘটে। এই ধর্মের প্রচারক আরো দুজন গুরু ছিলেন তারা হলেন -হাড়িপা ও কান্হপা বা কৃষ্ণাচার্য। তারা বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদেরও পদকর্তা ছিলেন। সেন যুগে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও নাথ ধর্ম টিকে থাকে এবং উদার মানষিকতার মুসলিম শাসনামলেও তাদের অস্তিত্ব ছিলো। এবরেন্দ্র অঞ্চলে মোট তিনটি নাথ ধর্মের প্রচারকেন্দ্রছিল।তন্মধ্যে যোগীর ঘোপা অন্যতম।
অন্য দুটি কোথায় অবস্থিত? এর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,অন্যদুটি হলো বগুড়ার যোগীর ভবন ও দিনাজপুরের গোরকুই যোগীর ভবন। এই তিনটি স্হানই ছিলো নাথ ধর্মাবলম্বীদের আবাস স্থল ও ধর্ম প্রচার কেন্দ্র।
তিনি আরো জানান১৯১৭-১৯১৮ সনে স্যার বুকানন হেমিলটন এই যোগীর ঘোপা গ্রামটি পরিদর্শন করেন,প্রত্নতত্ত্ব সমৃদ্ধ স্হানটি সম্পর্কে তিনি বলেন যোগীরঘোপার ছোট মন্দিরটি ধর্মীয় স্থান হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন্দিরটি হিন্দু ধর্মের মহাদেবের নামে শিবলিঙ্গ স্হাপিত ও উৎসর্গ কৃত। এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত পুরোহিত ওপুজারীদের,দ্বারা পরিচালিত।পাল রাজা দেবপালের (৮১০-৮৫০)সমাধি। মন্দিরটি পার্শ্বস্হ নিচু এলাকা থেকে উচুকরে একটি বিশাল জায়গার উপর ইট দিয়ে নির্মিত নদীর পশ্চিম সংলগ্ন মনোরম পরিবেশে অবস্থিত।পরম্পরায় বয়ে আসা যোগীদের মতে ভূমির উঁচু স্থানগুলো রাজা দেব পালের বাড়ির বা অবকাশ যাপন কেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষ।রাজার মৃত্যুর পর এখানেই তার সৎকার করে সমাধির উপর ছত্রী নির্মাণ করা হয়।তিনি আরো বলেন যে, যোগীরঘোপার একমাইল পশ্চিমে আমাইর গ্রামে ঠিক একিভাবে পালরাজা মহিপালের (১০৭০-১০৭৫) বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেক্সান্ডার কার্নিংহাম ১৮৭৯ সালে যোগীর ঘোপা গ্রামটি পরিদর্শন করেন।এই স্থানেছিলো রাজা দেবপালের বাড়ি এবং এখানে তাকে সমাহিত করা হয়।গোরক্ষ নাথের মন্দিরের সম্পর্কে তিনি জানান,যোগীর ঘোপার অভ্যন্তরে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের পূর্বপার্শে রয়েছে ভগ্নগ্রস্হ একটি মন্দির যা গোরক্ষ নাথের মন্দির নামে পরিচিত। পশ্চিমমুখী ও আয়তাকার এই মন্দিরটিতে সন্মুখের একটি দর্জাদিয়পই প্রবেশ করা যায়। সন্মুখস্ত কক্ষটিতে এখনো গোরক্ষ নাথের পুজা অর্চনা করা হয়। ভগ্নগ্রস্হ এই কক্ষটির নিচে ভূগর্ভস্হ আরোও একটি কক্ষ পরিলক্ষিত হয়। মন্দির অংশটি বেশ প্রাচীন।গোরক্ষ নাথের সমাধি ? সম্পর্কে তিনি বলেন,প্রায় হাজার বছর আগে নাথ ধর্মের প্রচারক গোরক্ষ নাথের সমাধিও যোগীর ঘোপায় রয়েছে বলে কথিত আছে।পাল বংশের রাজত্বকালে,৮২১-৮৬১ সালে যোগীর ঘোপা একটি প্রসিদ্ধ ধর্মীয় স্থানের মর্যাদা লাভ করে।মহাদেবের মন্দির,যোগীর ঘোপার অভ্যন্তরে ছ’ফুট প্রসস্থ একটি লম্বা কক্ষ ছিলো। ডানে ও বামে ছিলো দুটি প্লাটফর্ম বা বেদী এদের একটিতে ছিলো তুলশী গাছ আর একটিতে ছিল শিবের ত্রীশূল। সন্মুখে যোগীদের বাসস্থান ডান দিকে ছিলো আরোও দুটি মন্দির। একটিতে সাধারণ শিব লিঙ্গ অপরটিতে চতুর্মুখী শিবলিঙ্গ। বিষ্ণু বা কৃষ্ণ মন্দির,মহাদেবের মন্দিরের বাইরে ছিলো ৩ ফিট ৭ইঞ্চি উঁচু একটি লিঙ্গ আসলে এটি ছিলো একটি বিষ্ণু মূর্তি। এটি শিশু কৃষ্ণ ও মাতা দেবকী বলে মনে হয়। তবে বর্তমানে মন্দিরের সেই আদিরূপ বা অবকাঠামো কোনটিই আর বিদ্যমান নাই।পূজার উপলক্ষ। এই গোরক্ষ নাথের মন্দিরে যে পূজা করা হয় তা মূলত লোক কাহিনী। পার্শস্হ রাজবাড়ীর কন্যা “বিমলাদেবী”গুরু গোরক্ষ নাথের দর্শনে মন্দিরে আসেন। তিনি গুরুর প্রতি বিমুগ্ধ হয়ে গোরক্ষনাথের সেবার্থে বাকী জীবন মন্দিরে পূজাঅর্চনার মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করেন।বর্তমানে এখানে পুজার অনুষঙ্গ মুলত গোরক্ষ নাথ ও বিমলা দেবীর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাই মূলত পুজার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।যোগীর ঘোপার মন্দির গুলো পরিচালনার জন্য দেবোত্তর হিসেবে ৯৬’৭০ একর দান কৃত জমি রয়েছে। যার c, s খতিয়ান নং ২৪১। মন্দিরটি দীর্ঘদিন পশ্চিম বঙ্গের পুরহিত ওপূজারিদের দ্বারা পরিচালিত হত। নাথ সম্প্রদায়ের অনুসারিরা আজও এখানে পূজা অর্চনা করে থাকেন নওগাঁর পত্নীতলার এই যোগীর ঘোপা নাথ পন্থীদের আশ্রম ধর্ম প্রচার কেন্দ্র ও আবাসস্থলের ইতিহাস জানা যায়।
লেখক প্রভাষক মোঃ আব্দুর রাজজাক (রাজু)
Leave a Reply