ইবনে ফরহাদ তুরাগ,নিজস্ব প্রতিবেদকঃ-
নদী ও প্রান-প্রকৃতি রক্ষায় ৯ দফা দাবি সহ ঢাকার প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা নদী ও তার ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান ও নৌকা র্যালী করলো নদী রক্ষা ও প্রান-প্রকৃতির সংগঠন নোঙর ট্রাস্ট।
আজ ২৬ জানুয়ারি (শুক্রবার) দিনব্যাপী বুড়িগঙ্গা এবং আদি বুড়িগঙ্গা নদীতে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।
এই দিন দুপুরে আদি বুড়ীগঙ্গা নদী থেকে খোলামোড়া পর্যন্ত দেশের নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় ৯ দফা দাবিতে নৌকা র্যালী করে নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন (নোঙর ট্রাস্ট)।
বুড়িগঙ্গা একশত জন নদীর নৌকার মাঝিদের কম্বল বিতরণ করার মাধ্যমে নৌ-র্যালী উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঢাকা-০২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট মোঃ কামরুল ইসলাম।
নোঙর ট্রাস্ট চেয়ারম্যান সুমন শামস এর সভাপতিত্বে ও ৫৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুল ইসলাম মাদবরের সার্বিক তত্বাবধায়নে অনুষ্ঠানে সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছিলেন সামাজিক সংগঠন রিভার জাষ্টিস ও সচেতন নগরবাসী।
অনুষ্ঠানের সভাপতি নোঙর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস বলেন, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কামরাঙ্গীরচরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলতো আদি বুড়িগঙ্গা। সে নদীতে এখানে জলের প্রবাহ দেখা যায় না। যত দূর দৃষ্টি যায়, শুধু ময়লা আর অবর্জনা। প্রায় সারে সাত কিলোমিটার নদীর জায়গায় জায়গায় দখল, গজিয়ে উঠেছে কাঁচাপাকা অবৈধ স্থাপনা। এ দৃশ্য এখান রাজধানীর চারদিকের প্রত্যকেটি নদীর। এই মরণদশা থেকে রাজধানী ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে আদি বুড়ীগঙ্গা নদী, বুড়ীগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদী, তুরাগ নদীসহ ঢাকা শহরের হারিয়ে যাওয়া ৪৭টি খাল বাঁচাতে হবে। তা না হলে এই শহর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
বেড়িবাঁধ আর চরের মধ্যবর্তী জায়গায় বুড়িগঙ্গার একটি চ্যানেল ছিল আদি বুড়িগঙ্গা নামে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদি বুড়িগঙ্গা আধমরা বুড়িগঙ্গায় রূপ নিয়েছে। স্থানীয়দের দখল আর দূষণে পানির প্রবাহ খুঁজে পাওয়া দায়। বেড়িবাঁধ সিকসনের বিপরীতে কামরাঙ্গীরচরের রনি মার্কেট গড়ে উঠেছে নদীর জায়গা দখল করে। বেড়িবাঁধ থেকে চরে ঢুকতে হয় ছোট একটি সেতু পার হয়ে। প্রাায় ৫০ ফুট দীর্ঘ সেতুর নিচে তাকালে এখন আর পানির প্রবাহ দেখা যায় না। এমনকি সেতু থেকে দুই পাশে তাকালে কোথাও পানির প্রবাহ চোখে পড়ে না। বরং পানি প্রবাহের বদলে সেখানে জমে আছে ময়লার বিশাল স্তূপ। কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত আদি বুড়িগঙ্গার প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এই চ্যানেলের দুই পাশে এখনো রয়েছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপ না থাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা গত ৫০ বছর সময় ধরে আদি বুড়িগঙ্গার ওপর গড়ে তুলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বহুতল ভবন।
তিনি আরো বলেন, বেড়িবাঁধ ইসলামবাগ থেকে কালুনগর পর্যন্ত বেড়িবাঁধের পাড় ঘেঁষে দেখা গেছে বিপুল অবৈধ স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে পাকা, আধাপাকা ও টিনের ঘর, রিকশার গ্যারেজ, ট্রাকস্ট্যান্ড, ট্রেম্পুস্ট্যান্ড, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কারখানা। রয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও। বেড়িবাঁধের সড়ক ও কামরাঙ্গীরচরের দুই পাশ থেকে ময়লা ফেলে আদি বুড়িগঙ্গা ভরাট করা হয়। ময়লা ফেলে ভরাটের পর সে অংশে গড়ে তোলা হয় রিকশার গ্যারেজ বা কাঁচা স্থাপনা। রনি মার্কেট অংশে খালের ওপর গড়ে উঠেছে মার্কেটের বর্ধিতাংশ, পাকা স্থাপনা। দিনের পর দিন ময়লা ফেলে বেড়িবাঁধ অংশের সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে বিশালাকার টেম্পুস্ট্যান্ড, ট্রাকস্ট্যান্ড, দোকান ও বসতবাড়ি। কোম্পানিঘাট এলাকায় খালের ওপর কায়দা করে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে মেটাডোর কোম্পানি। মসজিদ বরাবর আদি বুড়িগঙ্গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে কোম্পানিটির কারখানা। মেটাডোরের পাশে থাকা পান্না ব্যাটারিও দখল করে আছে আদি বুড়িগঙ্গা। কোম্পানি দুটির বিপরীত পাশে রয়েছে স্থানীয়দের আরও অনেক অবৈধ স্থাপনা।
কামরাঙ্গীর চরের পরে হাজারীবাগ, ঝাউচর, বউবাজার ও রায়েরবাজার অংশে আদি বুড়িগঙ্গার দেখা মেলে নামমাত্র। দুই পাড়ের বসতবাড়ি, বাজার ও কারখানা থেকে সব বর্জ্য ফেলে হচ্ছে পানিতে। ফলে পানির প্রবাহের জায়গা ময়লার বিশাল স্তূপ গড়ে উঠেছে। ভাসমান এ ময়লার স্তূপ এতটাই পুরু হয়েছে যে, এর ওপর দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারে। নিচে পানির প্রবাহ রয়েছে তা নিশ্চিত হতে অন্তত এক ফুট পরিমাণ ময়লা সরাতে হয়।
বুড়িগঙ্গা নদীসহ রাজধানীর চারপাশের নদী দখল-দূষণ এবং নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচিতে দেশের সকল শ্রেণির নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে দেশের নদী ও প্রাণ প্রকৃতি সংরক্ষণ নোঙর বাংলাদেশেরে এ আন্দোলন ধারাবাহিক ভাবে চলমান থাকবে বলে জানান তিনি।
নদী রক্ষার ৯ দফা দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী মোঃ আবুল হোসেন সরকার, কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ সোলায়মান মাদবর, বুড়ীগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক জনাব মিহির বিস্বাস, সচেতন নাগরিক সমাজের আহবায়ক জনাব রুস্তম খান, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি জনাব আমির হোসেন মাসুদ, রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও নদী গবেষক আইরিন সুলতানা, স্বপ্নের সিঁড়ি এর নির্বাহী পরিচালক উম্মে সালমা, নদী ও পরিবেশ কর্মী জনাব মোম্মদ সেলিম।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন নোঙর বাংলাদেশ পরিবারের সম্মানিত সদস্য এফ এইচ সবুজ, ফজলে সানি, আবির বাঙালী, মোহাম্মদ আবদুর রহিম, আমিনুল হক চৌধুরী, বাহারুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, শরফরাজ শাওন, সৈয়দা কবিতা রিমি, মীর মোকাদ্দেস আলী, মোহাম্মদ শাজাহান, মোহাম্মদ জালাল হোসেন জুয়েল, মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির, কাজী নূরউদ্দীন রানা, মাহাতাব, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনসহ আরো অনেকে।
নোঙর ট্রাস্টের ৯ দফা দাবি:
১) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলের ইস্তেহারে দেশেরে সকল নদী, খাল, বিল, বিল, হাওরবাওর, পুকুর, জলাশয়, প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নে সকল সাংসদের শপথ গ্রহণ করতে হবে। ২) আদালতের নির্দেশ মেনে ১৯৪০ সালের সিএস নকশাসহ আরএস, বিএস, এসএ, ড্যাপ এবং জলাধার আইন অনুযায়ী সকল জেলার নদী-শাখা নদী ও খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে এবং সীমানা পিলার স্থাপন করে পুণরায় প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। ৩) রাজধানীর হারিয়ে যাওয়া ৪৭টি খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে বৃত্তাকার নৌপরিবহণ চালু করতে হবে। ৪) নদীর সকল বাঁধ, স্বল্প উচ্চতার সতেু-কালর্ভাট অপসারণ করে নৌপরিবহনে যোগ্য নৌপথ তৈরী করতে হবে। ৫) নদী দখল-দূষণকারী, বালু খেকো, ভূমি দস্যুদেও সকল ধরণের নির্বাচনে অংশগ্রহনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। ৬) সমুদ্র-পাহাড়, বনভূমি, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসকারী ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। ৭) দেশের স্বার্থে 'জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭' অনুস্বাক্ষর করার মাধ্যমে সকল অভিন্ন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের বাধা অপসারণ করতে হবে। ৮) ফারাক্কা-তিস্তাসহ ৫৪টি আর্ন্তজাতিক নদীর পানি ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহারের চুক্তি স্বাক্ষর করা এবং ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ৯) আগামী দিনে নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চত করতে দেশের নৌপথে নিহত সকল শহীদের স্মরণে ‘২৩ মে, কে জাতীয় নদী দিবস’ ঘোষণা করে সরকারি ভাবে গেজেটভূক্ত করতে হবে।